মোল্লা নাসির উদ্দিন:
২০২৩ সালের হজে নানা অনিয়ম ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়া অভিযুক্ত হজ্ব এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে শুনানি কার্যক্রম জোরশোরে শুরু হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শিগগিরই শাস্তির আওতায় আসছে বেপরোয়া হজ্ব এজেন্সিগুলো। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ্ব শাখার উদ্যোগে দু’টি গ্রুপে ত্রিশটি অভিযুক্ত হজ্ব এজেন্সির বিরুদ্ধে শুনানি কার্যক্রম চলছে। অভিযুক্ত হজ্ব এজেন্সিগুলোর স্বত্বাধিকারীদের কেউ কেউ শুনানিতে উপস্থিত না হয়ে অফিসের ম্যানেজারকে পাঠাচ্ছে। শুনানি সম্পন্ন হলেই দায়ী হজ্ব এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রতারক হজ্ব এজেন্সিগুলোকে ছাড় দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। সুষ্ঠু ও সুন্দর হজ্ব ব্যবস্থাপনার স্বার্থে অপরাধের হার অনুযায়ী অভিযুক্ত হজ্ব এজেন্সিগুলোকে শাস্তি পেতেই হবে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (হজ্ব) মো: মতিউল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সম্প্রতি ধর্ম সচিব আবদুল হামিদ জমাদ্দার তার দপ্তরে গত হজ্বে বদরপুর ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরসের প্রতারণার ঘটনা স্বীকার করে বলেন, আল্লাহর মেহমান হাজীদের সাথে প্রতারণার ঘটনা খুবই দু:খজন। ধর্ম সচিব বলেন, প্রতারক বদরপুর ট্রাভেলসকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। গত হজ্বে মক্কা-মদিনায় হাজীদের যথাযথ সেবা প্রদান না করে চরম হয়রানি এবং হাজীদের টাকা নিয়ে উধাও হবার ঘটনাও ঘটেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানার হজ্বযাত্রী মো: জলিলুর রহমান ও তার স্ত্রী মাহবুবা বেগম গত হজ্বে যাওয়ার জন্য বদরপুর ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরসকে ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। বদরপুর ট্রাভেলস হাজীর স্বল্পতাহেতু অঞ্জন এয়ার ট্রাভেলসের মাধ্যমে তাদের হজ্বে পাঠানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। কিন্ত তাদের হজ্বে না নিয়ে প্রতিস্থাপন করে বেশি টাকা পেয়ে অন্য দু’জন হজ্বযাত্রীকে হজ্বে নিয়ে যায়। ফলে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে হজ্বযাত্রী জলিলুর রহমান ও তার স্ত্রী মাহবুবা বেগম হজ্বে যেতে পারেনি। তাদের হজ্বে ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা ফেরত না দিয়েই বদরপুর ট্রাভেলসের মালিক সউদী চলে যায়।
প্রতারণার শিকার জলিলুর রহমান গত ৮ আগস্ট ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল হামিদ জমাদ্দারের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে প্রতারক বদপুর ট্রাভেলস ও অঞ্জন এয়ার ট্রাভেলসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ক্ষতিপূরণসহ হজ্বের ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা উদ্ধারের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর ইসলামিক ফাউন্ডেশনে শুনানিতে বদরপুর ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী মু’তাসিম বিল্লাহ উপস্থিত না হয়ে ম্যানেজার শাহাদাতকে পাঠায়। শুনানিতে হজ্বযাত্রী জলিলুর রহমান ও তার স্ত্রী মাহবুবাকে হজ্বে নিতে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে তাদের পাওনা হজের ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা ফেরত দিতে ২০ দিনে সময় চায়। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ্ব শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, বদরপুর ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরস হাজীদের সাথে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে গর্হিত কাজ করছে। বদরপুর ট্রাভেলসকে প্রতারণার দরুণ শাস্তি পেতেই হবে। এক প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র সহকারী সচিব বলেন, প্রতারণার শিকার হজ্বযাত্রী জলিলুর রহমান ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে হজ্বে টাকা নিয়ে হজ্বে না নিয়ে তাদের সাথে জুলুম করা হয়েছে। তাদের ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা পরিশোধের জন্য বদরপুর ট্রাভেলসের ম্যানেজার শাহাদাত ২০ দিনের সময় নিয়েছে। সিনিয়র সহকারী সচিব বলেন, আরো একটি হজ্ব এজেন্সির প্রতারণার শাস্তি দেয়া হবে।
ইতালির প্রবাসী দম্পতির ১২ লাখ টাকা নিয়ে তাদের এবার হজে না নিয়ে সউদী আরবে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন বদপুর ট্রাভেলসের মালিক। প্রতারণার শিকার প্রবাসী হজযাত্রী শাহিন আহমেদ মুন্সী হজ্বে যেতে না পেরে চোখের পানি ফেলে নিরাশ মনে ইতালি ফিরে গেছেন। বদরপুর ট্রাভেলসের হজ্ব লাইসেন্স বাতিল এবং আত্মসাতকৃত হজ্বের টাকা উদ্ধার ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মক্কা মুকাররমাস্থ বাংলাদেশ হজ্ব মিশনের কাউন্সিলর (হজ্ব) এর নিকট লিখিত অভিযোগ দালিখ করা হয়েছে। বদরপুর ট্রাভেলসের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার শাহিন আহমেদ মুন্সী তার ভগ্নিপতি জিলহজ্ব ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী মো: আব্দুস ছাত্তার চাকলাদারকে অভিযোগ পেশ এবং হজের আত্মসাতকৃত ১২ লাখ টাকা উদ্ধারের ক্ষমতা হস্তান্তর করে ইতালি চলে গেছেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর শুনানিতে ইতালি প্রবাসী দম্পতির হজ্বের ১২ লাখ টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে কোনো সুরাহা হয়নি।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কেরাণীগঞ্জের হজ্বযাত্রী মির্জা কবির আহম্মেদ গত ২৪ সেপ্টেম্বর ধর্ম সচিবের কাছে লিখিত জবাবে জানান, আমার পরিবারের ৪জন হজ্বে যাওয়ার জন্য প্রতারক বদরপুর ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরসকে ২৬ লাখ টাকা পরিশোধ করি। শুধু হজ্ব ভিসা ও পাসপোর্ট দিয়ে বিমানের টিকিট না দিয়ে হজ্ব এজেন্সির মালিক গা-ঢাকা দিয়ে সউদী চলে যায়। পরে তিনি নিরুপায় হয়ে প্রায় ৮ লাখ টাকা দিয়ে বিমানের টিকিট কেটে হজ্বে যান। মক্কা মদিনায় বাসা ও খাওয়া বাবদ ৪ জনের আরো ৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়। প্রতারণার শিকার হাজী মির্জা কবির আহম্মেদ ৪ জনের বিমান ভাড়া এবং মক্কা-মদিনার বাসা ও খাওয়ার খরচ বাবদ ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৩শ’ টাকা পাওনা উদ্ধার এবং প্রতারক হজ্ব এজেন্সির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি হজের সময়ে মক্কায় কাউন্সিলর (হজ্ব) এর কাছে প্রতারক হজ্ব এজেন্সি অঞ্জন এয়ার ট্রাভেলসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পাওনা টাকার আদায়ের অভিযোগ পেশ করেছেন। অঞ্জন এয়ার ট্রাভেলসের মুনাজ্জেম আমিনুল ইসলাম মির্জা কবির আহমেদের ৪ পাসপোর্ট মদিনায় আটকিয়ে হজ্ব মিশন থেকে অভিযোগ তুলে নেয়ার চক্রান্ত করেছিল। কিন্ত মদিনা হজ্ব মিশনের শীর্ষ কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন অঞ্জন এয়ার ট্রাভেলসের কাছ থেকে পাসপোর্ট উদ্ধার করে তাদের দেশে পাঠান। জানতে চাইলে জিলহজ্ব ট্রাভেলসের মালিক আব্দুস সাত্তার চাকলাদার বলেন, প্রবাসী দম্পতি হজ্বযাত্রীর ১২ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনার বিচার চেয়ে মক্কাস্থ কাউন্সিলর হজ্বের কাছে লিখিত অভিযোগ পেশ করা হয়েছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত শুনানিতে ইতালি প্রবাসী দম্পতির হজের ১২ লাখ টাকা উদ্ধারে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তিনি এসব প্রতারণার সুষ্টু তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্মমূলক শাস্তির দাবি জানান। এ ব্যাপারে বদরপুর ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরসের স্বত্বাধিকারী মু’তাসিম বিল্লার মোবাইলে একাধিক বার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।