খুলনা ডেস্ক:
এক সময়ের খুলনায় ক্লাব সংস্কৃতি ছিল জীবন্ত এক ঐতিহ্য। পাড়া-মহল্লার যুব সমাজের মিলনমেলা, খেলাধুলা, বই পড়া, সাংস্কৃতিক আয়োজন, এমনকি সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে ক্লাবগুলো রেখেছে অনন্য ভূমিকা। সেই ঐতিহ্য আজ শুধুই স্মৃতিতে রয়ে গেছে। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি, জীবনযাত্রার ব্যস্ততা এবং সামাজিক উদাসীনতার কারণে আজকের খুলনায় ক্লাব সংস্কৃতি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
খুলনার খালিশপুর, দৌলতপুর, সদরসহ শহরকেন্দ্রিক এলাকাগুলোতে এক সময় ছিল শত শত ক্লাব। পাবলা সবুজ সংঘ, দুর্বার সংঘ, ফিরোজ স্মৃতি সংসদ, মিলানি ক্লাব, চানমারী গ্রিন বয়েজ ক্লাব—এই সব নামগুলো একসময় তরুণদের অনুপ্রেরণার কেন্দ্র ছিল। আজ অনেক ক্লাবেরই শুধু সাইনবোর্ড টিকে আছে, কার্যক্রম নেই বললেই চলে। কোনো কোনো ক্লাব তো বহু বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।
একসময়ের জমজমাট শিল্পাঞ্চল খালিশপুরের কথা বললে উঠে আসে পুরনো দিনের স্মৃতি। সেখানে ছোট-বড় অনেক ক্লাব ছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, খেলাধুলা, আড্ডা, কেরাম খেলা, সমাজসেবা—সব কিছুতেই সক্রিয় ছিল এসব ক্লাব। মাসিক আয়োজন ছিল খাবার-দাবার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কিন্তু পাটকল বন্ধ হওয়ায় মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে যেতে শুরু করলে ক্লাবগুলোও ধীরে ধীরে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে।
টুটপাড়ার চানমারী বা ফরাজিপাড়ার মতো এলাকাগুলোতেও তরুণদের হাত ধরে ক্লাব গড়ে উঠেছিল। ইয়ং বয়েজ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মিলন শেখ বলেন, “২০০২ সালের দিকে গোডাউনের ঘর নিয়ে ক্লাব তৈরি করি। সমাজের পাশে দাঁড়াতাম। আজ সবাই ছড়িয়ে পড়েছে, ক্লাবও নেই।”
তবে সব ক্লাবই যে হারিয়ে গেছে, তা নয়। এখনো দুর্বার সংঘ ক্লাবের মতো কিছু সংগঠন খেলাধুলা ও সামাজিক কাজে সক্রিয় রয়েছে। ক্লাবটির সভাপতি মেহেদী জানান, তারা ১৯১ সদস্য নিয়ে খেলাধুলা ও মানবিক কাজ পরিচালনা করছেন। তবে তিনিও মনে করেন, আধুনিকতার চাপে ক্লাব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের আগ্রহ নেই বললেই চলে।
খুলনা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আইনাল হক জানান, জেলার প্রায় ৪০০টির মতো ক্লাব ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অনুমোদন রয়েছে। তবে সঠিক তদারকি ও উন্নয়নের অভাবে অনেকগুলোই নিষ্ক্রিয়। লাইসেন্স নবায়নের নিয়ম এখনও পাস না হওয়ায় অনেক সংগঠন কার্যক্রম বজায় রাখতে পারছে না।
জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক উন্নয়নে ক্লাবের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। প্রশাসন ইতিমধ্যে খেলাধুলা ও সামাজিক কার্যক্রমে উৎসাহ দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে।
আজকের তরুণদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন, নেতৃত্ব বিকাশ এবং সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। যদি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ক্লাব সংস্কৃতিকে আবার সক্রিয় করা যায়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে এক সুস্থ, মানবিক এবং সমাজসচেতন পরিবেশ। খুলনার হারানো ঐতিহ্য হয়তো আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে নতুন করে।