আনিসউর রহমান আনিস:
(১ম পর্ব প্রকাশের পর) মেঘনা গ্রুপকে বাঁচাতে অন্যায় পথ অবলম্বন এবং রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক। বিগত সরকারের অন্যতম দোসর, দুর্নীতিবাজ, অনিয়ম আর ক্ষমতার অপব্যবহারে মোটা অংকের টাকার কামিয়ে নেওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি মেঘনা গ্রুপকে বাঁচানোর গ্যারান্টি দিয়েছেন বিপুল অংকের টাকা বিনিময়ের এমন অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
উল্লেখ্য, মেঘনা গ্রুপের কাছ থেকে মেঘনা নদীর জমি উদ্ধারের লক্ষ্যে তদন্তকমিটি ১২ দফা সুপারিশ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমি উদ্ধারের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও জেলা প্রশাসক এই বিষয়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি মেঘনা গ্রুপের বিরুদ্ধে। ডিসি মহোদয় কালক্ষেপণ করেছেন এবং আইনকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসার পথ মেঘনা গ্রুপকে তৈরি করে দিয়েছেন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের একটি সূত্র থেকে জানা যায়, তদন্ত প্রতিবেদন আওয়ামীকালীন মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ হতে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসককে দেওয়া হয়েছে, সেই আলোকে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে নদীর জমির উদ্ধারের ব্যবস্থা নেবেন। যতটুকু জানা যায়, এই ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন তেমন কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। এই বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য ছয়টি জাতীয় সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হিউম্যান অ্যান্ড নেচার ডেভেলপমেন্ট কনসোর্টিয়াম (এইচএনডিসি) সেপ্টেম্বর ২০২৪ নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক বরাবর একটি চিঠি প্রদান করেন। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার মেঘনা গ্রুপ কর্তৃক মেঘনা নদীর সংক্রান্ত সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী গৃহীত পদক্ষেপ এবং তা কতটা কার্যকর করা হয়েছে সেই বিষয়ে সর্বশেষ তথ্যাদি প্রদান বা জানানো।
এ প্রসঙ্গে এইচএনডিসি এর মহাসচিব ড. মোহাম্মদ সেলিম রেজা এই প্রতিনিধির কাছে বলেন, ১২/৯/২০২৪ তারিখে প্রেরিত আমাদের চিঠিটি ডিসি অফিস গ্রহণ করে এবং তা ডিসি মহোদয়কে মার্ক করে তার টেবিলে পাঠানো হয়। কিন্তু তিন সপ্তাহ পর আমাদের প্রতিনিধি যোগাযোগ করলে ডিসি মোহাম্মদ মাহমুদুল হক জানান, চিঠি আমার কাছে আসেনি। তবে তিনি চিঠিটি কোথায় আছে খোঁজ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বলেন। নারায়ণগঞ্জ ডিসি অফিসের মনজুর নামে একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে জানান, জেলা প্রশাসক স্যারের কাছে ফাইল দেওয়া আছে, নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবেন। প্রায় সাড়ে তিন মাস অতিক্রান্ত হলেও কোন সদউত্তর জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তবে এইটুকু জানা যায়, ডিসি সাহেব ফাইলটির উপর লিখে রেখেছেন দুদক সংক্রান্তবিবিধ, মেঘনা গ্রুপ।
অপরদিকে এইচএনডিসি’র মহাসচিব জানান, বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের ডিজি বরাবর একটি চিঠি প্রদান করা হয়েছে। তিনিও এর কোন জবাব দেননি। এই প্রতিনিধিকে ড. মুহাম্মদ সেলিম রেজা আরো বলেন, এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার ডিসির আচরণ রহস্যজনক। মেঘনা গ্রুপকে অবৈধ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য তিনি নির্লিপ্ত থাকছেন। ডিসি মহোদয় দেশের প্রতি, পরিবেশ ও নদীর প্রতি অন্যায় আচরণ করছেন। ড. সেলিম আরও বলেন, প্রয়োজনে আমরা নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেব। মেঘনা গ্রুপ থেকে মেঘনা নদীর জমি উদ্ধারের জন্য প্রতিবাদের যত ধরনের পদক্ষেপ আছে, তা আমরা প্রয়োগ করব। মেঘনা নদীকে দিনে দিনে গ্রাস করার এক নির্মম দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে মেঘনা গ্রুপ। এদের দখলদারিত্ব নিয়ে জাতীয় ও নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো নানা শিরোনামে গত এক যুগ ধরে নানান সংবাদ পরিবেশিত হয়ে আসছে। মেঘনা গ্রুপ ১৯৯৮ সালে মেঘনাঘাট থেকে একটি ছোট্ট কারখানা হতে ৪৮টি শিল্প কারখানা গড়ে তুলে মেঘনা নদীর পাড়ে। প্রয়োজন পড়ে কলকারখানার জন্য শত শত একর জমির। হাতের কাছে মেঘনার পাড় মেঘনার শাখা নদী দখলের মহোৎসব চালিয়ে যেতে থাকে এবং মেতে ওঠে মোস্তফা কামাল। একে একে দখলে নেয় সোনারগাঁও উপজেলার বৌদ্ধের বাজার ইউনিয়ন, হোসেনপুর ইউনিয়ন এবং পিরোজপুর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত চর রমজান, শোনাউল্লাহ, পূর্বও পশ্চিম দামোদরদী, দুধঘাটা, টেঙ্গরচর, ছয়হিস্যা, নরসূনদী, আষাঢ়িয়ার চর এবং ঝাউচর এলাকায় মেঘনা গ্রুপ মেঘনা নদীর জমির মধ্যে ৭/৮ টি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। ব্যক্তি মালিকানার জমি বিক্রয় না করলে তাদের বিরুদ্ধে নেমে আসতো অত্যাচার ও মিথ্যো মামলা।
মেঘনা গ্রুপ মোট জমি কিনেছে ৫৬৬ বিঘা। ২০১০ সাল থেকে মেঘনা নদী ও তার শাখা নদী, ব্যাক্তি মালিকানা এবং সরকারি খাস জমিসহ প্রায় ১৬০০ বিঘা জমি দখলে নিয়েছে অবৈধ পন্থায়। জমি দস্যুতার প্রমাণ সাপেক্ষে এমন নজির স্থাপনের দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। মেঘনা গ্রুপের এমন নির্মম দখলের কর্মকাণ্ডে গতিপথ হারাতে বসেছে মেঘনা নদী। সেইসঙ্গে হুমকির মুখে পড়েছে শতবর্ষের পুরণো ও লক্ষাধিক মানুষের সমাগম স্থল স্থানীয় আনন্দবাজার।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১০ সাল থেকে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের ছত্রছায়ায় দখল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে তারা। ব্যক্তির মালিকানার অনেক জমি বিক্রয় না করলে তাদের বিরুদ্ধে নেমে আসে অত্যাচার। বেনামী ভুয়া ও জাল দলিলের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয় অসহায় মানুষের জমি জিরাত। এসব কর্মকাণ্ডে সহায়তা করে স্থানীয় সরকারি প্রশাসন, ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যরা এবং স্থানীয় সরকারি দলের মাস্তান বাহিনী। আগামী পর্বগুলোতে এসব সহায়তাকারী দখলবাজদের তালিকা এবং তাদের কর্মকান্ড প্রকাশ করা হবে।
সরকারি পর্যায়ে সহায়তাকারীরা হলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা, বিআইডব্লিউটি-এর কতিপয় কর্মকর্তা, স্থানীয় পরিবেশ অধিদপ্তর এবং সোনারগাঁও উপজেলা নির্বাহী ও ভূমি কর্মকর্তা। মেঘনা গ্রুপে দখলদারিত্বের সময় ম্যানেজ করা সম্ভব হয়েছে মোস্তফা কামালের পালিত কর্মকর্তাদের সহযোগিতায়। কিন্তু তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদের দৃষ্টি এড়ায়নি উল্লেখিত বিষয়টি। এছাড়া এই বিষয়ে অত্যন্ত তৎপর এবং দেশ প্রেমের পরিচয় দিয়েছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান হাওলাদার। তারই নেতৃত্বে তদন্তে মেঘনা গ্রুপের ভূমিদস্যুতার প্রমাণ সাপেক্ষে রেকর্ডপত্রসহ মন্ত্রিপরিষদে ৩৪ পৃষ্ঠা তদন্তরিপোর্ট জমা প্রদান করেন। সেই রিপোর্টের আলোকে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন এবং নারায়ণগঞ্জ পুলিশ প্রশাসনসহ সরকারি আরো চারটি দপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়া হয় মেঘনা নদী জমি উদ্ধারে, পরবর্তীতে তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সম্প্রতি এই বিষয়টি সর্বশেষ কী অবস্থায় আছে তা জানাতে ছয়টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ন্যাচার অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট কনসোর্টিয়াম (এইচএনডিসি) নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু তারা রহস্যজনক কারণে এর কোন জবাব দেয়নি। বারোটি সরকারি মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের সমন্বয়ে গঠিত পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্টের কী ছিল আগামী পর্বগুলোতে তা বিস্তারিত পাঠকের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে নারায়নগঞ্জের ডিসি মোহাম্মদ মাহমুদুল হককে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সামনা সামনি কথা বলার আমন্ত্রণ জানান। তার কাছে নদী কমিশন থেকে চিঠি আসার কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা ইউএনওকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছি। তিনি এক্ষেত্রে কোর্টের নিষেধাজ্ঞার কথাও বলেন। তবে এ বিষয়ে জানতে মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোস্তফা কামালকে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি এবং ম্যাসেজ দিলেও এর কোনো উত্তর দেনননি। অন্যদিকে ব্রান্ড ডিভিশনে কর্মরত হাবিবের ফোনে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ঠ ব্যাক্তি এবং তার মতামত নেবার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো রেসপন্স করেননি।