পর্ব-২
- মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের লুটপাটের গোমর ফাঁসকারীই এখন হোতা
- লুটপাটের ভাগ বঞ্চিত অধ্বঃতনের গোমর ফাঁস খেলায় লুটেরা হোতার পদস্খলন
- সমঝোতায় এখন নয়া হোতা সেই হিসাব রক্ষক রাসেল
- নতুন ডিজি বসানোতেও ওই হোতা কৃতিত্বের দাবিদার
কামরুজ্জামান মিল্টন:
জামাই ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ (সাবেক ডিজি), আবার তারই ফুফাতো ভাই আইজি আব্দুল্লাহ আল মামুন। আর মাছ সচিব ও তার বন্ধু। অন্যদিকে বউ তাহসেনা বেগম তনু নিজেই আ.হোসেন আমু’র ভাগ্নি। এমন কি-মাছ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ছিলেন তাদের ঘরের লোক। এসব শক্তির সম্মিলিতরূপের মহাশক্তিধর বদৌলতে “বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে’র মহারাজা বনে বসেছিলেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত ডিজি ড. মোহসেনা তনু। আর এ বলেই তিনি দুর্দান্ত প্রভাবশালী বলয় তৈরী করে বেপরোয়া লুটপাটের নিরাপদ আস্তানা বানিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটিকে। একটা লম্বা সময় ধরে চলছিল-এ অবস্থা। আর ভাগ বঞ্চিতের ক্ষোভে ফুঁসছিল ভিন্নমতের একটি সংখ্যক লোভী অধ্বঃতন।
এসব লুটপাটের তথ্য ফাঁস করে হলেও হোতাকে বাগে আনার চেষ্টায়ও মত্ত ছিল তাদের কেউ কেউ। শেষমেষ তাই’ই ঘটলো, অর্থাৎ ভারপ্রাপ্ত সাবেক ডিজি ড. তনু’র সব লুটপাটের অভিযোগ চাউর করতে মরিয়া হয়ে ছুটছিলেন সেখ রাসেল নামের হিসাব রক্ষক জনৈক অধ্বঃতন। আর ওই সব অভিযোগের ভিত্তিতে তৈরী কয়েক পর্বের প্রতিবেদনের একটি প্রচারিত হতেই পদস্খলন ঘটে ড. তনু’র। আর তাতেই তিনি রাসেলকে বাগে নিয়ে আপাতত বিষয়টি ধামাচাপা দেন।
এর আগে একটি অন-লাইনে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলে তা সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতনের নজরে আসে। আর অভিযোগের গুরুত্বে তাৎক্ষনিক ড. তনুকে ওই ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (ডিজি)’র পদ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। এসুযোগে ওই রাসেল তার কৃতিত্বের দাবিদার হয়ে বাচানোর দায়িত্বেও লুফে নিয়ে মত্ত হয় ধান্ধাবাজিতে। রাসেল দুই-এক সহযোগী দালাল মিলে অন্য পত্রিকায় ওই প্রতিবেদনের প্রতিবাদ ছাপানোসহ বিষয়টি থামিয়ে দিতে ড. তনু’র কাছ থেকে মোটা অংকের টাকাও হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ ওঠে। এপর থেকে সেই রাসেলও এখন ওই জামাই-বউ’র পুকুর ডাকাতি তুল্য লুটপাটের শরীকদার হয়ে তনু চক্রের দুর্গন্ধ ঢাকতে হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
আসল ব্যাপারটা হলো-হয়তো বা মাছ চুরি, গাছ চুরি, এটা-ওটা সব চুরি হলেও পুকুর চুরিটা, হয়তো কথার কথা। কিন্তু “বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে’র হোতাগিরির সুযোগে ‘জামাই-বউয়ে’র শুধু গাছটা বাদে পুকুর, মাছসহ সব নানা কিছু নির্বিঘ্ন চুরি তো নয়, যেন ডাকাতি হয়েছে। সোজা কথায়-একচ্ছত্র প্রভাবের যথেচ্ছা লুটপাটে প্রতিষ্ঠানটি ন্যুজ হয়ে এসব নিয়ম-দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছিল বলে অভিযোগ বরাবরের। আর তা একটা লম্বা সময় ধরে ওই জামাই-বউ অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে’র পর্যায়ক্রমের হোতা দম্পতির জামাই ইয়াহিয়া মাহমুদ ও স্ত্রী ড. মোহসেনা বেগম তনু’র পুকুর, মাছ সব ডাকাতিসহ নানা কু-কাণ্ডে গোটা ইনস্টিটিউটকে লুটপাটের হাট-বাজার বানিয়ে ফেলেছিলেন। সেই সাথে অভাবনীয় আখের গুছিয়েও বহাল তবিয়্যতেই ছিলেন। কিন্তু তাতে ভাগ বঞ্চিতের মতবিরোধে কোনঠাসা অধ্বঃতন চক্রের সেখ রাসেলের তৎপরতার শুরুতেই তনু ধরাশায়ী হন। আর স্বার্থ হাসিলের সুযোগে নয়া হোতা বনে যায় সেই হিসাব রক্ষক সেখ রাসেল।
বউ ড.তনু’র আগে জামাই ইয়াহিয়া মাহমুদ আট বছর বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ডিজি’র দায়িত্বে ছিলেন। মেয়াদ শেষ হলে মাছ প্রতিমন্ত্রী শ,ম রেজাউল করিম তাকে দুই বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ান। এরপর শ ম রেজাউল, ডিজি ইয়াহিয়া মাহমুদ ও তার বন্ধু তৎকালীন সচিব রওনক মাহমুদ যোগশাজসে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটকে লুটপাটের অভয়ারন্যে পরিণত করেন। চালন-অবাধ লুটপাট, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বেপরোয়া ধান্ধাবাজি। আর তার নিরাপত্তায় গড়ে তোলেন-নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। তাদের ওই সব অবাধ ধান্ধাবাজির দিকে ফিরে তাকালে তার উপর নামতো হামলা-মামলাসহ নানা অত্যাচারের খড়গ্। জামাই সদ্য সাবেক ডিজি, আইজি আব্দুল্লাহ আল মামুন তারই ফুফাতো ভাই। আর মাছ সচিব ও তার বন্ধু। অন্যদিকে বউ নিজেই আ. হোসেন আমু’র ভাগ্নি। এ তিন মহাশক্তির দাপটেই স্ত্রী তনুকে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট’র ডিজি’র সাময়িক দায়িত্বও বসিয়েছিলেন। আর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে জামাই’র মত একই কায়দায় তনুও শুরু করেন কর্মচারী-কর্মকর্তাদের দমন-পীড়নসহ নির্বিঘ্ন লুটপাট। যার ধরন ওই কথিত পুকুর, মাছ চুরি-ডাকাতি বলাটাই ঢের নয়। কারণ যেখানে-বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রায়োগীক গবেষণা ছাড়াই হয়েছে-মিথ্যা গবেষণার তথ্য প্রচারের মহাপ্রতারণা। চলেছে নির্বিঘ্ন-ধান্ধাবাজি। লুটপাট করেছে-সরকারী অর্থ।
মাছ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের দেখভালে ১০৬ জন আউট সোর্সিং’এ নিয়োগের নামে হাতিয়ে নিয়েছেন-কাড়ি কাড়ি টাকা। সেই সাথে করেছেন-বিএফআরআই কর্মচারী নিয়োগে কোটি টাকার বাণিজ্য। তা থেকে মাছ মন্ত্রীকে উপঢৌকণ হিসেবে কোটি টাকা দিলেও আস্থাভাজন সহকারী পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌসকে দিয়েছেন-নতুন গাড়ী। কোন টেন্ডার আহ্বান বা কাজ ছাড়াই ইলিশ গবেষণা প্রকল্পের চেক লিখে করেছেন- টাকা আত্মসাৎ। তবে মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ইয়াহিয়া মাহমুদ বন্ধু সচিব রওনক মাহমুদকে সামুদ্রিক মৎস্য অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’র টাকায় কিনে দেন-দামি ফ্ল্যাট। অন্যদিকে-কোন গবেষণা ছাড়াই মুক্তা প্রকল্পসহ নানা মনগড়া প্রকল্পের নামে চালানো হয় নিছক ধান্ধা-ফিকির। মুক্তা গবেষণার পুকুরে গবেষণার উৎপাদিত মুক্তা তো দুরে থাক, মাছ বিক্রির টাকা পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে করা হয়েছে ভাগ-বাটোয়ারা।
‘হুয়া ডানে’র রিপোর্ট কপি করে উপস্থাপন হয়েছে-ভুয়া রিপোর্ট । প্রচার করা হয়- মিথ্যা গবেষণার তথ্য। এছাড়া কোর গবেষণার নামে চলে- রাজস্ব বাজেটের গবেষণার অর্থ লুটপাট। অবকাঠামো নির্মাণ কাজের রাজস্ব বাজেটের অর্থ ভুয়া বিলের মাধ্যমে করা হয়-লুটপাট। এমন কি গবেষণার মাছ ও লেকের মাছ বিক্রির টাকা পর্যন্ত করা হয় গায়েব। হ্যাচারীতে উৎপাদিত রেনু পোনা বিক্রির অর্থ নাম মাত্র জমা দিয়ে বাকি করা হয়-আত্মসাৎ। আর কোন কাজ ছাড়াই এনএটিপি প্রকল্পে’র সমুদয় অর্থ করা হয়-গায়েব। শুধু তাই’ই নয়, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিয়োগে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগকে থোড়াই কেয়ার করে হোতা ইয়াহিয়া মাহমুদ ও তৎকালীন মাছ মন্ত্রী রেজাউল করিম যোগসাজশে ৪৩ টি পদে নিয়োগ দিয়ে ঘুষ হিসেবে লুফে নেন-কোটি কোটি টাকা। সেই সাথে মহা প্রতাপশালী ইয়াহিয়া মাহমুদের কাছে নারী সহকর্মীদের অনেকের নির্বিকারে সম্ভ্রম হারানোর অভিযোগ ওই দপ্তরেই চাপা মাটি হয়েছে । আর ব্যত্যয়ে পেয়েছে-শাস্তি।
জামাই সাবেক ডিজি ইয়াহিয়া মাহমুদ এভাবে একটা মেয়াদে দূর্দান্ত দাপটে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট’এ লুটপাট করে দেশে বিদেশে গড়েছেন-সম্পদের পাহাড়। আর জামাই’র আসনে বসে বউ হোতা হয়ে একই ভাবে লুটপাটে মত্ত ছিলেন। যার পেছনে বসে কলকাঠি নাড়ছেন-সেই লুটপাটের হোতারূপী সাবেক ডিজি ইয়াহিয়া মাহমুদ। আর এসবের নিরব সাক্ষী হয়ে একটা মেয়াদে ওই প্রতাপশালী সিণ্ডিকেটের কাছে জিম্মি ও বঞ্চিত-লাঞ্ছিত হয়েও মুখ বুজে ছিলেন একটা সংখ্যক কর্মচারী-কর্মকর্তা। তাদের পক্ষে অবস্থা বিবেচনায় এসব জল ঘোলায় লেগেছিল ওই সেখ রাসেল। তবে তিনি ড.তনুকে বস করে ফেলেন। ফায়দা হাসিলের সুযোগে রাসেল তনু’র সাথে সমঝোতায় নয়া হোতা সেজে বসেন। এসব বিষয়ে হিসাব রক্ষক সেখ রাসেল জানতে চাইলে বলেন, তিনি সব সময় সত্যের, ন্যায়ের সাথেই আছেন। বর্তমান ডিজিকেও তিনি বসিয়েছেন।
প্রতিবেদনের আগের পর্বে ড. তনু’র কাছে এসব অভিযোগের বিষয়ে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে বলেন, হিসাব রক্ষক সেখ রাসেলের তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ রটাচ্ছে। তিনি আরো জানান, অনিয়মের দায়ে ওই রাসেলকে শোকজ করায় ক্ষুব্ধ হয়ে সে তাকে হেয় করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আর প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরই ফুটে উঠেছে সেই চিত্র। সেই রাসেল এখন তারই লোক হয়ে উল্টো অভিযোগ ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
আসল ব্যাপারটা হলো ওই হিসাব রক্ষক সেখ রাসেল সিণ্ডিকেট ওই ‘জামাই-বউ’ সিণ্ডিকেটের বে-পাত্তায় অনেকটা কোনঠাসা ও ধরাশায়ী ছিল। অধিকন্ত তনু সিণ্ডিকেট রাসেল সিণ্ডিকেটের হোতা সেখ রাসেলের বেপরোয়া অনিয়ম ও ছলচাতুরির লুটপাটে বাগড়া দিলেই বাধে অন্তর্দ্বন্দ, শুরু হয়-এক অন্যের বিরুদ্ধের লুটপাটের গোমর ফাঁসের তৎপরতা। এ প্রতিযোগীতামূলক লুটপাটের গল্পটা বেশী লম্বা হওয়ায় সব সময় সত্যের, ন্যায়ের সাথেই থাকা সেখ রাসেলের হিসাব নিকাসের ফাঁক-ফোঁকরে লুটপাটেরছোট-খাট্ট গল্পটা এর পরের পর্বে আসছে।
আর এব্যাপারে মৎস্য ও প্রানীজ সম্পদ উপদেষ্টার দফতর থেকে জানায়, অভিযোগ তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।