অনলাইন ডেস্ক:
স্বাস্থ্যখাতের বহুল আলোচিত শতকোটি টাকার মালিক ড্রাইভার মালেক দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় বর্তমানে জেলে রয়েছেন। বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁসকারী ও দূর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত আরেক শতকোটি টাকার মালিক ড্রাইভার সৈয়দ আবেদ আলীও আছেন জেল হাজতে। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সিদ্ধিরগঞ্জ সার্কেলের ড্রাইভার জাহিদুল ইসলাম আরজু কোটি কোটি টাকার মালিক ও নব্য জমিদার হয়েও আছেন বহাল তবিয়তে। তিনি কাউকেই তোয়াক্কা করেন না।
সুফি সাধকের ন্যায় আচরণ করা ড্রাইভার পদে কর্মরত আরজু দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদেরও হার মানিয়েছে। তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ড্রাইভার। তিনি নরসিংদীতে কর্মকালীন সময়ে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্ধর্তন কর্মকর্তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে তাদের হয়ে মাসোহারা আদায় করতেন।
বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চল সার্কেল বিভাগের সহকারী কমিশনার মাসুদুর রহমানের ড্রাইভার পদে কর্মরত মো. জাহিদুল ইসলাম আরজুর খুটির জোর আসলে কোথায়? তিনি কিভাবে অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ এবং বিপুল অর্থের মালিক হলেন, তার আয়ের উৎস কি? এসব খতিয়ে দেখার কি প্রয়োজন মনে করেন না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃপক্ষ?
আরজু অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ায় তার অহংকার ও দাম্ভিকতা বেড়ে গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও ড্রইভার আরজুর অবৈধ ধন-সম্পদের খবর জানেনা। আরজু সামান্য একজন গাড়িচালক হয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকান-পাট ও গাড়ি ব্যবসা করছেন। তার এই আয়ের উৎস কি তা নিয়ে সর্বমহলে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি কিভাবে এত টাকার মালিক হয়েছেন তা কেউ বলতে পারেন না।
এই আরজুর বিরুদ্ধে শত অভিযোগ থাকলেও তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, আরজু সবাইকে ম্যানেজ করেই তার অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
দ্যা ফিন্যান্স টুডের এক গোপন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অফিস শেষে বের হওয়ার পর আরজু গাড়ি নিয়ে চলে যান বিভিন্ন ব্যবসায়ী এবং কারখানাগুলোতে। তাকে দিয়েই ব্যবসায়ীরা ম্যানেজ করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উর্ধতন কর্মকর্তাদের।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের সাথে ছিলো আরজুর দহরম মহরম সম্পর্ক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে আরজু মন্ত্রীর বাসায় গিয়ে মোটা অংকের টাকাও দিয়ে আসেন। এছাড়া আরজু মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রশাসনকেও আন্দোলনের সময় মোটা অংকের টাকা দেন বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন ছাত্রদেরকে মারধর এবং হত্যার ঘটনায় আরজু ও তার আত্নীয়স্বজনদের হাত থাকলেও তা এখন ধামাচাপা দিতে টাকার বস্তা নিয়ে নেমেছে আরজু। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন আরজু নিজেকে বগুড়ার সন্তান পরিচয় দিয়ে সব জায়গায় প্রভাব বিস্তার করার অপচেষ্টা করছেন বলেও এলাকায় গুঞ্জন উঠেছে।
মোহাম্মদপুর এলাকায় আরজুকে সবাই ভ্যাট কমিশনার (পূর্ব) হিসেবে চিনে ও জানে। জনৈক ব্যক্তি এই প্রতিবেদককে বলেন, "আরজু স্যারকে আপনি ড্রাইভার বলে তার সম্মান নষ্ট করছেন। তিনি কি এবং তার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার কোন ধারণাই নেই।"
একই অবস্থা দেখা গেছে সিদ্ধিরগঞ্জ বিভাগে তার অফিসে গিয়ে। সেখানে তার পরিচয় ড্রাইভার থাকলেও তিনি সেকেন্ডম্যান হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত।
আরজু ড্রইভার হলেও তার চলনবলন প্রশ্নফাসঁকারী আবেদালির মতো। তিনি দামি পাঞ্জাবী, জুতা এবং নামীদামী ব্র্যান্ডের পারফিউম ব্যবহার করেন। অহংকার তাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যা নাকি তার আচরণেও প্রকাশ পায়।
খুবই উগ্রমেজাজি আরজুর ভয়ে অন্য সব ড্রাইভাররা সবসময়ই আতংকে থাকেন। তাকে নিয়ে কিছু বললে বা প্রতিবাদ করলে অভিযোগকারীকে সাজা ও বদলি করিয়ে নিজের ক্ষমতার কথা জানান দেন সবাইকে।
আরজু নিজেকে অনেক ক্ষমতাধর মনে করেন। তার বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্টের কেউ মুখ খুলে কথা বলার সাহসই পায় না। আরজু মিডিয়ার কর্মীদেরকেও খুবই অবজ্ঞা করেন। উপরস্থ কর্মকর্তারাও আরজুর ধমকে থাকেন তটস্থ। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে আরজু বড় স্যারের গাড়িচালক এবং অঢেল টাকার মালিক।
এফটি টীমের গভীর অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যমতে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উর্ধতন একজন কর্মকর্তার ড্রাইভার মো. জাহিদুল ইসলাম আরজুর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদিয়া হাউজিং এর শিয়া মসজিদের বিপরীতে কাচাঁবাজারে চারটি দোকান আছে। দোকানগুলোর নাম্বার হলো ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯। তিনি এই দোকানগুলো সিটি কর্পোরেশন থেকে ক্রয় সূত্রে মালিক। এই দোকানগুলো পরিচালনা করছেন তার আপন ভাই টোকন। তারা দুজনে আবার আপন ভায়রা ভাই। এসব দোকানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এবং পাখির নানাবিধ খাদ্যসামগ্রী বিক্রি করা হয়।
আর.কে রেন্ট-এ-কার নামে তার ভাড়ায় চালিত গাড়ির ব্যবসা রয়েছে। এই রেন্ট-এ-কারের গাড়িগুলো সাধারণ ভাড়ায় চালানো হয় না। প্রতিটি গাড়ি কাস্টমস ও ভ্যাট অফিসগুলোতে মাসিক ভাড়ায় দেয়া হয়েছে।
মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদিয়া হাউজিং এর রোড নম্বর-২ এর ৪৭ নং এ `মেঘ বাড়ি` নামে মোহাম্মদিয়া আর্কিট নামক ভবনের ৬ তলায় ডাবল ইউনিটে ৩০ হাজার টাকা বাসা ভাড়ায় দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া থাকেন আরজু।
এছাড়াও বসিলা গার্ডেন সিটির আরাম মডেল টাউনের সিটি প্রজেক্টে রোড নাম্বার-১, বাড়ি নাম্বার-১২ বিলাসবহুল দশ-তলা এপার্টমেন্ট রয়েছে তার। তিনি এলাকায় লাট ভাই নামে পরিচিত। তাকে কেউ ড্রাইভার হিসেবে চিনেন না।
আরজুর তিন ছেলে এবং এক মেয়ে। সবাই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করেন। তার বড় ছেলে এলাকার মানুষের কাছে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত।
নিজের ও ছেলেদের চলার জন্য চারটি মোটর সাইকেল আছে। একেকটি গাড়ির বাজার মূল্য সাড়ে ৬ লাখ টাকা করে। ২০১০ মডেলের ৫টি এক্স নোহা ও ২০০৬ মডেলের ৪টি নোয়াসহ মোট ৯টি মাইক্রোবাস আছে ড্রাইভার আরজুর।
আরজুর মাসিক বেতন ৪৮ হাজার টাকা। এছাড়া প্রতি মাসে তার আড়াইশো ঘন্টা ওভারটাইম আছে। কাজ না করলেও এই ওভারটাইমের টাকা তার জন্য নির্ধারিত।
আরজুর আয়ের উৎস
১২ বছর নরসিংদী (শিল্পাঞ্চল খ্যাত) জোনে কর্মরত থাকা অবস্থায়ই আরজু মূলত তার অধিকাংশ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন। ওই জোনের আওতাধীন বিভিন্ন মিল-ফ্যাক্টরী এবং কলকারখানা চষে বেড়াতেন গাড়ি নিয়ে। সন্ধ্যার পর থেকে নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত অবাধ বিচরণ ছিলো বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়ীদের কাছে। নরসিংদীর বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।
তারা বলেন, আরজু লেবাসধারী একজন ব্যক্তি। বিভিন্ন সময়ে সে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অভিযানের ভয়ভীতি দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তার স্যারদেরকে ফোনে ধরিয়ে দিতেন। প্রতিটি ফ্যাক্টরী থেকে তিনি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে নিয়মিত মোটা অংকের মাসোহারা আদায় করতেন। নরসিংদীতে কর্মরত থাকাকালীন তিনি ছিলেন মূর্তমান আতংক।
সিদ্ধিরগঞ্জ সার্কেলেও সে সমানতালে তার অবৈধ কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছেন। উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ড্রাইভার হওয়ার কারণেই আরজু এতোটা বেপরোয়া। তিনি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসিক মাসোহারা আদায় করলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি কখনো।
প্রসঙ্গতঃ সিদ্ধিরগঞ্জ বিভাগের চারটি সার্কেল সিদ্ধিরগঞ্জ, মৌচাক, জালকুড়ি ও হিরাঝিলের বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, মিল-ফ্যাক্টরী , দোকান-পাঠ ও অফিসগুলোতে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন আরজু। এছাড়াও ছোট-মাঝারি নিবন্ধনহীন ফ্যাক্টরীর মালিকরা আরজুর ভয়ে থাকেন আতংকে। তিনি ব্যবসায়ীদেরকে সব সময় অভিযানের ভয় দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তাছাড়া ভ্যাটের কাগজ-পত্রেও রয়েছে অনেক ঘাপলা। এই সবকিছুই নিজের স্যারকে দিয়ে ম্যানেজ করেন আরজু।
আরজুর আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য হচ্ছে, তিনি বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের সাথে উঠাবসা করেন। বিভিন্ন অশ্লীল কর্মকাণ্ডে লিপ্ত মেয়েদের সাথে রয়েছে তার গভীর সখ্যতা। ঢাকার বিভিন্ন হোটেলগুলোতে এসব মেয়েদের নিয়ে তার অবাধ যাতায়াত রয়েছে বলেও জানা গেছে। এপর্যন্তই শেষ নয়, তিনি মদের বারেও যান। একটা সময় মদ খেয়ে মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতেন। তার এসব তথ্য অফিসের সবাই জানেন। কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে নারাজ।
এখন জনমনে প্রশ্ন হচ্ছে, একজন ড্রাইভারের এহেন বিলাসবহুল জীবন-যাপন, গাড়ি-বাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স এর উৎস কোথায়?
আরজু নিজেকে একজন পরহেজগার মানুষ দাবি করেন। উত্থাপিত এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, "চাকুরী থেকে প্রাপ্ত বেতনের সুবাদে যেসব সম্পদ করেছি তার হিসেব ইনকাম ট্যাক্স ফাইলে দেয়া আছে। আমার বিরুদ্ধে লিখে কোন লাভ নেই। আমার কিছুই হবেনা।"
এই বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন কমিশনার এফটি টীমকে বলেন, তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ এসেছে। পর্যায়ক্রমে তা যাচাই-বাচাই করা হচ্ছে। তবে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে গেলে কয়েকজন কর্মকর্তা তাকে সার্বিক সহযোগিতা করার কারণে অনেক পদক্ষেপই শেষ পর্যন্ত নেয়া সম্ভব হয়নি।
একটি রাষ্ট্রের অক্সিজেন হলো “রাজস্ব”। আর এই রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে যারা গিলে খেতে চায় তারা দেশ ও জাতীর শত্রু। দ্যা ফিন্যান্স টুডের অনুসন্ধানে এরকম শত শত আরজুদের চিত্র উঠে এসেছে। এমনকি ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ড্রাইভারের চাকরি হাতিয়ে নেয়ার তথ্য ও প্রমানও রয়েছে এই প্রতিবেদকের কাছে।
এছাড়াও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধিকাংশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই রয়েছে ভয়াবহ দূর্নীতির অভিযোগ। দূর্নীতি দমন কমিশনের সৎ ও নির্লোভ কোন ইউনিট দিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান ও নিরপেক্ষ তদন্ত না করলে এসব দূর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনা দুস্কর হয়ে পড়বে। কারন “সর্ষের মধ্যেই রয়েছে ভূত”।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত দূর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের নেয়া সংস্কার কর্মসূচী খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করা। নয়তো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দমন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।