মোহাম্মদ মোশাররাফ হোছাইন খানঃ
বিশ্বের সর্বাধুনিক কৌশলী লুটপাটে ধ্বংসপ্রায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত । বিশেষতঃ ইসলামী ব্যাংকিং খাত । বাংলাদেশ ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং ডিভিশনের এর জুলাই মাসের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ইসলামী ব্যাংকিং খাতে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা ডিপোজিট অতিরিক্ত বিনিয়োগ হয়েছে। কয়েকজন আর্থিক খাত বিশ্লেষক এটিকে বিনিয়োগ না বলে ভয়াবহ রকমের লুটপাট হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন । পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে বিশ্বস্ত কয়েকজন লুটেরার মাধ্যমে গত সারে পনের বছরে এ লুটপাট সংঘটিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে । সবচেয়ে বেশী লুটপাট হয় সাইফুল আলম মাসুদ বা এস. আলমের প্রতিষ্ঠিত এস. আলম গ্রুপের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকে বাংলাদেশ পিএলসিতে । ২০১৭ সালের পর হঠাৎ বিলিয়নিয়র হিসেবে গজিয়ে উঠা এস. আলম একটি প্রশাসনিক সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে দেশের অর্থিক খাতের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান এই ব্যাংকটি থেকে বিপুল অংকের টাকা লুট করে নেয় । গত প্রায় চার বছর এই লুটপাটের সারথীর ভূমিকা পালন করেন প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান ব্যবস্হাপনা পরিচালক মো. মনিরুল মাওলা ।
জানা যায়, মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর শরীয়া ভিত্তিক এই ব্যাংকটিতে ৫ বছরের জন্য ব্যাবস্হাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নিয়োগ পান । ১ জানুয়ারি ২০২১ সাল থেকে এমডি হিসেবে দায়ীত্বে পালন করেন । এই সময়ে মনিরুল মাওলা ছিলেন যেন আলী বাবার “চিচিং ফাক” নামক পাস ওয়ার্ড । হক্কানী পীরের মুরিদ সর্দার আলী বাবা এস. আলম “চিচিং ফাক” বলার সাথে সাথে এমডি এবং এস. আলমের নিয়োগ প্রাপ্ত অনুচরেরা সাধারন আমানতকারীদের আমানতের টাক নিরাপদে বের করে নেয়ার পথ করে দেন । গত ৫ আগষ্ট দেশে পট পরিবর্তনের পর তার বিশ্বস্ত এই অনুচররা পালালেও মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন শরীয়াহ ভিত্তিক এই ব্যাংকটিতে ।
বিশ্ব শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকিং জগতের পথিকৃত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির হাজার হাজার কোটি টাকা এক লুটেরার হাতে তুলে দিয়ে ব্যাংকটিতে কিভাবে এখনও তিনি এমডি হিসেবে দায়ীত্ব পালন করছেন এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে রয়েছে নানা প্রশ্ন। এ দিকে এমডি মনিরুল মাওলাকে অপসারণের দাবী নিয়ে ব্যাংকটিতে যে কোন সময় অপ্রীতিকর একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও অস্বাভাবিক কোন ঘটনা হবে মনে করছেন অনেকে ।
কেউ কেউ বলেছেন, দেশে ৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তনের পরও এস. আলমের অনুগত এই এমডি মনিরুল মাওলা ও তার অনুগত অনুচরেরা মিলে ব্যাংকটি থেকে কয়েক শত কোটি টাকা বের করে নেয়ার চেষ্টা চালায় । কয়েক জন অফিসারের সাহসিক ভূমিকায় এই চেষ্টা ব্যর্থ হয় ।দক্ষিণ এশিয়ার সর্ব প্রথম ইসলামি শরিয়া-ভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি । প্রতিষ্ঠার পর থেকে গতানুগতিক সুদ-ভিত্তিক ব্যাংকিং-এর বিপরীতে শরিয়াহ ভিত্তিক বিকল্প হিসেবে ব্যাংকটি পরিচালিত হতে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে ব্যাংকটি খুব অল্প সময়ে আর্থিক খাতে শীর্ষস্থান দখল করে আজকের এ পর্যায়ে আসতে স্বক্ষম হয়েছে । ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি একটি অনুকরণীয় মডেলে পরিণত হয় প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যেই। এই সাফল্যে একে একে আরও দশটি ইসলামী ঘরানার ব্যাংক বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বেশ কয়েকটি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো এবং শাখা ব্যাংকিং চালু করেছে এবং কাংখিত সফলতাও পেয়েছে ।
ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের অধিকাংশ ছিলেন সমমনা ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী । এছাড়া, ব্যাংকটির একদল চরিত্রবান, ন্যায়নিষ্ঠ নিবেদিত কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রমে ধারাবাহিক ভাবে কাংখিত উন্নতির ধারায় সফলতার চুড়ায় পৌছে । ধারাবাহিক এই সফলতাই সময়ের ব্যবধানে আ. লীগ এবং এর মিত্রদের গাত্রদাহ হয়ে দাড়ায় । তারা ব্যাংকটির বিরুদ্ধে বারবার জংগীবাদের অর্থায়নের তকমা লাগানোর চেষ্টা করে। এর সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিতা মূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারনে তারা এ চেষ্টায় ব্যর্থ হয় । ইসলামী ব্যাংক জংগী অর্থায়নে জড়িত এটি কখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রমান করতে পারে নি । ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তন ও ব্যাংকটির সাফল্য নস্যাৎ করতে বিশেষ চক্রান্তে মাঠে নামে । পরিকল্পনা করা হয় কিভাবে এই বৃহত্তর ইসলামী ব্যাংকটিকে মিটগামারের পরিণতির দিকে নেয়া যায়। এ নিয়ে প্রথম দৃশ্যমান সরকারি পদক্ষেপ দেখা যায় ২০১০ সালে । ওই সময় পরিচালক পদমর্দাযায় একজন সরকারি কর্মকর্তাকে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর এই উদ্যোগের পরিপূর্ণ গতি পায়। বিযয়টি টের পেয়ে ঠিক এক বছর পরই ব্যাংকটিতে বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি পাঠায় মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক বিনিয়োগকারীরা । এসব উদ্বেগকে উপেক্ষা করে একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে ব্যাংকটিকে “এস. আলম গ্রুপে”র হাতে তুলে দেয়া হয় । ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের আগে থেকেই ব্যাংকের চট্টগ্রামস্থ খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক ছিল এস. আলম গ্রুপ । তবে মালিকানা পরিবর্তনের পর এই ঋণ গ্রহণের মাত্রা বাড়তে থাকে নাটকীয়ভাবে। তাদের নামি-বেনামি ঋণ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের উত্তরবঙ্গের শাখাতেও।
ইসলামী ব্যাংকের ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ এস. আলম গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান ছিল ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার তালিকায়। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান হলো এস. আলম স্টিলস অ্যান্ড রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, এস. আলম ভেজিটেবলস ওয়েল এবং এস. আলম সুপার এডিবল ওয়েল। ওই সময় এই তিন প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ছিল ৩,১০৮ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ — অর্থাৎ মালিকানা পরিবর্তনের ঠিক আগে এই ঋণ কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩,০০৮ কোটি টাকায়।
কিন্তু মালিকানা পরিবর্তনের পর হু হু করে বাড়তে থাকে এই ঋণের অংক। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ এস. আলম গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট দুইটি নতুন প্রতিষ্ঠান শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের তালিকায় যুক্ত হয় । আর ২০২১ সালের শেষ নাগাদ যুক্ত হয় নতুন আরও চারটি প্রতিষ্ঠান। এভাবে ২০২১ সালের শীর্ষ ঋণ গ্রহীতাদের তালিকায় এস. আলম গ্রুপ ও গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মোট নয়টি প্রতিষ্ঠান জায়গা করে নেয়।
২০২১ সালে এস. আলম স্টিলের ঋণ ছিল ৩,২২৪ কোটি টাকা, এস. আলম ভেজিটেবলের ৩,৮৫০ কোটি টাকা, এস. আলম সুপার এডিবেল ওয়েলের ৪,১৫৩ কোটি টাকা এবং এস. আলম কোল্ড রোল স্টিলের ১,৪৭৬ কোটি টাকা। এস. আলম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান শেমন ইস্পাত লি.-এর ঋণ ছিল ১,৪৪০ কোটি টাকা।আর গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলমের মালিকানাধীন ইনফিনিয়া সিআর স্ট্রিপসের ঋণ ছিল ১,৪১৮ কোটি টাকা । সাইফুল আলমের মেয়ের জামাই বেলাল আহমেদের নিয়ন্ত্রণাধীন ইউনিটেক্স এলপি গ্যাসের ঋণ ছিল ১,০১৫ কোটি টাকা । সাইফুল আলমের ভাগনে মোস্তান বিল্লাহ আদিলের আদিল করপোরেশনের ঋণ ছিল ১,০৬৭ কোটি টাকা। আদিলের স্ত্রী সাদিয়া জামিলের সাদিয়া ট্রেডার্সের ঋণ ছিল ১,০৭২ কোটি টাকা। মোস্তান বিল্লাহ আদিল আবার এস. আলম গ্রুপের মালিকানাধীন গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক ও আহসানুল আলমের ইনফিনিয়া স্পিনিং মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
এই নয় প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে ইসলামী ব্যাংকে এস. আলম গ্রুপের ঋণ বেড়েছে ছয় গুনেরও বেশি। ওই বছর অবধি ইসলামী ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ১৬.৫৫% ঋণই নিয়েছিল এস.আলম গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা এমডি হিসেবে দায়ীত্ব পালন কালীন সময় এস. আলমের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহ ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশী অংকের টাকা ইসলামী ব্যাংক পিএলসি থেকে লুঠ করে নেয় । এই কাজের সহযোগী হিসেবে তিনি ভূমিকা পালন করেন বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের সর্ব শেষ হিসাব অনুযায়ী এস আলমের মোট ২৯ টি প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকটির মোট পাওনা টাকার পরিমাণ ৫১৪৪৬ কোটি ৩৪ লাখ ১৭ হাজার ৭ শত ৫৯.০২ টাকা । এই অবাধ লুটপাটের সুযোগ তৈরী করে দেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি এর সাবেক এমডি মো. মাহবুবুল আলম ও বর্তমান ম্যানেজিং ডাইরেক্টর (এমডি) মুহাম্মদ মনিরুল মাওলা। সর্বগ্রাসী এই কাজে মুখ্য সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখেন অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডাইরেক্টর জেকিউএম হাবিবুল্লাহ, মো. আলতাফ হুসাইন, ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. আকিজ উদ্দিন, মো. মিফতাহ উদ্দিন, মো. সাব্বির, কাজী মো. রেজাউল করিম, মো. আব্দুল্লাহ আল-মামুন, আ.ফ.ম কামাল উদ্দিন, ক্যামেলকো তাহের আহমেদ চৌধুরীসহ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে এস. আলম কতৃক নিয়োজিত কয়েক জন কর্মকর্তা । (৫ আগষ্টের পর এদের অধিকাংশ পলাতক রয়েছে) এমনই অভিযোগ উঠেছে ব্যাংকটির ভিতর ও বাহিরের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এই টাকা লুটপাট ও পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার হয় খাতুন গন্জ, ও আর নিজাম রোড, চকবাজার, চাকতাই, রাজশাহী, রাজশাহী নিউ মার্কেট শাখা, অন্ধরকিল্লা, জুবিলী রোড, গুলশান সার্কেল-১ ও ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখা।
এ দিকে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিকে এস আলমের দখলমুক্ত করতে গত আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহে সোনালী ও রুপালী রুপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্হাপনা পরিচালক ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদের নেতৃত্বে পাচ সদস্যের একটি বোর্ড গঠন করে দেয়া হয়েছে । এই পূর্ণঃগঠন প্রক্রিয়ায় এস. আলমের নিয়োগ দেয়া এমডি মনিরুল মাওলাকে বহাল রেখে কতটা পূণঃগঠন করা সম্ভব এ নিয়েও বিভিন্ন মহলে রয়েছে নানা আলোচনা, সমালোচনা। উল্লেখ্য, বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব্যাংক কেলেঙ্কারির নায়ক এস. আলমকে হটানোর পর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির প্রতি ক্রমান্বয়ে আস্থা ফিরে আসছে। প্রতিনিয়ত রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে । এছাড়া বিভিন্ন শাখায় খোজ খবর নিয়ে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ ডিপোজিট প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ।